
মেজো মামার বিয়ে। ছোটো মামা আর মেজোমামা তাই এসেছেন দাওয়াত দিতে। বাড়ির সবাই বিয়ের তিন, দিন আগে মামাবাড়ি যাবে। শুধু আমিই যেতে পারব না। কারণ, আমার পরীক্ষা। হ্যাঁ, মামার যেদিন বিয়ে ঠিক, তার আগের দিনই আমার পরীক্ষা শেষ হবে।
মেজোমামা পরদিনই চলে গেলেন। শুধু ছোটোমামা রইলেন। তিনি বিয়ের তিন দিন আগে সবাইকে (অবশ্য আমি বাদে) নিয়ে যাবেন।
সেদিন খাওয়ার পর ছোটোমামার সঙ্গে গল্প করছিলাম।
আমি বলছিলাম, 'মেজোমামার বিয়েতে আর যাওয়া হলো না। ইশ! কত দিন ধরে বিরিয়ানি খাইনি। এরকম
চান্সটা মিস হয়ে গেল।'
ছোটোমামা খানিক চিন্তা করে বললেন, 'তুই কিন্তু যেতে পারিস।'
আমি উৎসাহিত হয়ে উঠলাম, 'কীভাবে?'
: তোর পরীক্ষা তো শেষ হবে ষোলো তারিখ, আর বিয়ে হলো গিয়ে সতেরো তারিখ। সুতরাং...
: তুমি তো বলতে চাও যে, আমার পরীক্ষা ঘোলো তারিখ শেষ হবে, তাহলে তো সতেরো তারিখে সহজেই যাওয়া যায় মামাবাড়ি। তুমি মনে করেছ এ কথাটা আমি ভেবে দেখিনি, কিন্তু তিনটের পরে তো আর ট্রেন নেই। মানে পরীক্ষা তো শেষ হবে সেই পাঁচটায়। কিন্তু তখন তো আর মামাবাড়ির কোনো ট্রেন পাব না। রাত্রিতে সেদিনের কোনো ট্রেনই নেই। দিনে মাত্র সাড়ে বারোটা আর তিনটায় দুটো ট্রেনই আছে। সুতরাং ষোলো তারিখেই পরীক্ষা দিয়ে মামার বাড়ি যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। যেতে হলে সেই পরের দিন। মানে সতেরো তারিখে সাড়ে বারোটার ট্রেনে যেতে হবে। সেই ট্রেন গিয়ে পৌঁছবে সন্ধ্যা সাতটায়। তাহলে আর গিয়ে লাভ কী, কারণ ততক্ষণে তো মামা বরযাত্রীসহ বিয়েতে রওনা হয়ে যাবেন। যদি মামার সঙ্গে বরযাত্রী হয়ে যেতে না-ই পারলাম, তবে আর গিয়ে লাভটা কী শুনি?
: উঁহু, আমি তা বলছি না।
: তবে?
: তুই যদি সোজা কনের বাড়িতে চলে যাস-
: তার মানে?
: তোর আমাদের বাড়িতে যাওয়ার আর কী দরকার? তুই সতেরো তারিখে সাড়ে বারোটার ট্রেনে সোজা কনের বাড়িতে চলে যাবি। তাহলে তুই সেখানে বরযাত্রীদের সঙ্গে মিলতে পারবি। আর তাহলে তোর বিরিয়ানিটাও মিস যায় না। কী বলিস?
আমি তো লাফিয়ে উঠলাম- থ্রি চিয়ার্স ফর ছোটোমামা। বললাম, 'মার্ভেলাস আইডিয়া।'
আনন্দে একবারে আকাশে যাওয়ার জোগাড় করছি। কিন্তু সেই মুহূর্তে ছোটোমামা যে-কথাটা বললেন, তাতে আমি আকাশে উঠতে উঠতেই ধপ করে পড়ে গেলাম। তিনি বললেন, 'কিন্তু একটা কথা কী জানিস ফোকলা?'
: কী?
: স্টেশনের নামটাই যে আমার মনে নেই।
: স্টেশনের নাম। কোন স্টেশনের?
: ওই কনের বাড়ি যেখানে সেখানকার স্টেশনের নামই ভুলে গেছি।
: অ্যাঁ, স্টেশনের নামই জানো না! তবে যাব কী করে? আমাদের বাসার কেউ জানে না?
: না বোধ হয়। শুধু মেজোভাইয়াই জানতেন। কিন্তু তিনি চলে গেছেন।
: তাহলে?
: আমি অবশ্য একটা উপায় বাতলে দিতে পারি।
: কী উপায়?
ছোটোমামা মনে মনে কী যেন একটা হিসাবে করলেন। তারপর বললেন,
: হ্যাঁ, কনের বাড়ির স্টেশন হলো ঢাকা থেকে বারোটা স্টেশনের পর। তুই যদি গুনে গুনে বারোটা স্টেশন পর নামতে পারিস, তাহলেই চলবে।
: নিশ্চয়ই পারব।
: স্টেশনে নেমে তুই একটা রিকশা নিয়ে বলবি যে, 'চৌধুরীদের বাড়িতে যাব'। ব্যস, তাহলেই চলবে। চৌধুরীরা ওখানকার নামকরা লোক। সবাই ওঁদের চেনে।
: আমি নিশ্চয়ই যেতে পারব।
মেজোমামার বিয়ের তিন দিন আগে বাড়িসুদ্ধ সবাই চলে গেল। শুধু আমিই রইলাম। যাওয়ার সময় সবাই উপদেশ দিয়ে গেল ভালো করে পরীক্ষা দিতে।
আমার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেল। আজ সতেরো তারিখ। আজই সাড়ে বারোটার ট্রেনে বিয়ে বাড়ি যাব। অপেক্ষা করে করে আর তর সইছে না। শেষ পর্যন্ত সাড়ে এগারোটায় বাড়ি থেকে বের হলাম। তারপর ধীরে-সুস্থে স্টেশনে উপস্থিত হলাম। ভেবেছিলাম গাড়ি ছাড়তে এখনও দেরি। ওমা! গিয়ে দেখি, গাড়ি চলতে আরম্ভ করেছে। লাফ দিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম। আমি যে কামরাতে উঠলাম, সে কামরায় অবশ্য ভিড় বেশি নেই। একজন ভদ্রলোক আমাকে বললেন, 'এই যে এখানে বসো খোকা, এখানে বসো।'
আমি তাঁর পাশেই বসে পড়লাম। হঠাৎ তাঁর ঘড়ির দিকে নজর পড়তেই আশ্চর্য হলাম, আরে এ যে মোটে বারোটা বাজে! গাড়ি ছাড়ার কথা তো সাড়ে বারোটায়! আমি একটু আমতা আমতা করে বললাম, 'আপনার ঘড়িটা কি- বন্ধ, মানে বলছিলাম কি আপনার ঘড়িটা ঠিকমতো চলছে তো?'
: কী বললে?
: আজ্ঞে আপনার ঘড়িটার কথা বলছিলাম।
: ঘড়িটার কথা? তা আমার ঘড়িটা যেই দেখে সেই কিছু না বলে পারে না। আমার ছেলে মিউনিখে থাকে কিনা, তাই সেখান থেকেই ঘড়িটা পাঠিয়েছে। খুব ভালো ঘড়ি। যে দেখে সে-ই প্রশংসা করে। ঘড়িটা তোমার কাছে ভালো লেগেছে নাকি? চেনটা দেখছ তো! কী সুন্দর! এখানে এসব জিনিস টাকা ছাড়লেও পাবে না।
: আজ্ঞে আমি সে কথা বলছি না।
: তবে কী বলছিলে?
: মানে আপনার ঘড়িটা ঠিকমতো টাইম দেয় তো!
: হুঁ, হুঁ, হাসালে দেখছি। এ ঘড়ি যদি ঠিকমতো টাইম না-দেয় তবে কোন ঘড়িতে ঠিকমতো টাইম পাওয়া যাবে বলতে পারো?
: তা তো বটেই, তা তো বটেই।
: তবে?
: আপনার ঘড়ি তো ঠিকমতো টাইম দেবেই, নিশ্চয়ই দেবে, দেওয়া তো উচিত। তবে ঘড়িটা যদি মাঝে মাঝে বন্ধ হয়ে যায়, কী বলে, সেটা যদি না চলে, কিংবা বলতে পারেন আপনি যদি ঘড়িটা না চালান-
: আমি ঘড়ি চালাতে যাব কেন? ঘড়িটা নিশ্চয়ই ঘোড়া নয়, তাহলে ঘড়ি চালানোর প্রশ্নই ওঠে না। ঘোড়ার পিঠে না-হয় বসা যায়, কিন্তু ঘড়িটা তো আমার পিঠেই, থুরি আমার হাতেই অবস্থান করে। আর এখন তো ঘোড়ার চেয়ে মোটর চালনাই ভালো, কিংবা ঘোড়ার বিকল্প বাইকেও চাপতে পারো।
: আজ্ঞে আমি বাইকে চাপতেও পারি না, আর ওসবে চড়ার ইচ্ছাও নেই। আর ঘোড়াকে তো মোটেই পছন্দ করি না। আমার মনে হয়, ঘোড়াও আমাকে নিশ্চয়ই পছন্দ করে না। কারণ, একবার ঘোড়ার পিঠে চাপতে গিয়ে ঘোড়াও এরকম রেগে গিয়েছিল যে আমার মনে হলো ওর পিঠে চড়াটাই ঘোড়া বোধ হয় পছন্দ করল না। আর তার ফলে রেগে গিয়েও যে ব্যাপার ঘটাল তাতে আমার সাড়ে তেত্রিশ ঘণ্টা বিছানায় শুয়ে থাকতে হয়েছিল। তাই বুঝতেই পারছেন ওসব ঘোড়া-টোড়া চড়া আমি মোটেও পছন্দ করি না।
: তা বাপু তুমি যেটায় চড়তে পছন্দ করো না সেটায় আমায় চড়তে বলছ কেন?
: কই, আমি তো আপনাকে ঘোড়ায় চড়তে কখনো বলিনি, শুধু আপনার ঘড়ির টাইমটা-
: জানতে চেয়েছিলে! তা তো দেখতেই পাচ্ছ বারোটা বেজে এই দু-তিন মিনিট।
: হ্যাঁ, তা তো দেখতেই পাচ্ছি, তবে গাড়ি তো ছাড়ে সাড়ে বারোটায়। তাই ভাবছিলাম, আপনার ঘড়িটা বোধ হয় চলছে না।
: না তো, গাড়ি তো বারোটায় ছাড়ে। আমি এ গাড়িতে প্রায়ই আসা-যাওয়া করি, আমি ভালো করেই জানি এ গাড়ি বারোটায় ছাড়ে।
আমি ভাবলাম কী জানি, ছোটো মামাই হয়তো গাড়ির টাইম বলতে ভুল করেছে। ভাগ্যিস, তাড়াতাড়ি এসেছিলাম। নইলে ট্রেনটা মিস হয়ে যেত। ভদ্রলোক আবার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'তা তুমি কোথায় নামবে?'
: স্টেশনের নাম জানি না, তবে ঢাকা থেকে বারোটা স্টেশন পরে নামব।
: বারোটা স্টেশন পরে!
ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মনে মনে যেন একটা হিসাব করলেন। তারপর হঠাৎ উৎফুল্ল হয়ে উঠলেন, 'আরে আমি যে স্টেশনে নামছি তুমিও তাহলে সেই স্টেশনেই নামছ।' ভদ্রলোক আমাকে স্টেশনের নামটি বললেন।
এমনি সময় সে গাড়ি কোনো স্টেশনে যেন থামল। তারপরই আমাদের কামরায় চেকার এল। সবার কাছে টিকিট চেয়ে আমার কাছেও টিকিট চাইল। আমি সেই ভদ্রলোকের কাছ থেকে স্টেশনটির নাম জেনে নিয়েছিলাম। তাই আট আনা ফাইন দিয়ে চেকারের কাছ থেকে ওই স্টেশনের টিকিট করে নিলাম।
গাড়ি কিছুক্ষণ পরেই চলতে আরম্ভ করল। ভদ্রলোক আমায় জিজ্ঞাসা করলেন, 'তা তুমি সেখানে কোথায় যাবে?'
: সেখানে চৌধুরী বাড়ি যাব।
: বলো কী- এ্যাঁ! আমিও তো চৌধুরীদের বাড়ির লোকই। চৌধুরী সম্পর্কে আমার মামাতো ভাই। তা চৌধুরীদের তুমি কী হও?
: আজ্ঞে আমি অবশ্য কিছু হই না। তবে আমার মামার সঙ্গে আজ চৌধুরী সাহেবের মেয়ের বিয়ে। তাই সেখানে চলেছি।
: কিন্তু বিয়ে তো আজ নয়।
: আজ নয়?
: না। আজ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তারিখ বদলে দেওয়া হয়েছে। কাল বিয়ে হবে। তুমি কি একাই এসেছ?
: হ্যাঁ, আমি একাই এসেছি। আজ বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। তাই আমি সোজা ঢাকা থেকে কনেপক্ষের বাড়ি যাচ্ছি, কথা ছিল সেখানেই বরপক্ষের সঙ্গে মিলিত হব।
: তা ভালোই করেছ, একদিন আগে এসে জায়গাটা ভালো করে দেখে-টেখে যেতে পারবে।
আমি একটু আগ্রহের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করলাম, 'দেখার কোনো জিনিস আছে?'
: তা থাকবে না কেন? মাইল তিনেক ভিতরে গেলেই পদ্মবিল। বিরাট বিল। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি আছে সেখানে।
যত ইচ্ছে শিকার করতে পারো। শহরের পশ্চিমে বিরাট মাঠ। সেখানে ছেলেরা খেলাধুলা করে। তারপর ওদিকে আবার একটু জঙ্গলের মতো আছে। আগে অবশ্য ঘন জঙ্গলই ছিল। তবে এখন সেই জঙ্গল আর নেই। পাতলা দু-একটা ঝোপঝাড় যা আছে। এখন ছেলেরা ওখানে পিকনিক করতে যায়। তারপর উত্তর দিকে...
আমি আর কিছু বললাম না। সন্ধ্যার দিকেই গন্তব্যস্থানে পৌঁছে গেলাম। ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে চৌধুরীদের বাড়িতে গেলেন। আমি বৈঠকখানায় বসলাম। তিনি ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আরও একজন ভদ্রলোক (মনে হয় ইনিই সেই চৌধুরী সাহেব) ও আমার সমবয়সি কয়েকটি ছেলে সেখানে এল। সেই ভদ্রলোক আমাকে দেখিয়ে বললেন, 'বুঝলে হে চৌধুরী, এই হলো তোমার জামাইয়ের ভাগনে।'
চৌধুরী সাহেব আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'তা খোকা তুমি এখানে বসে রয়েছ কেন? ভিতরে এসো, ভিতরে
এসো।'
ভদ্রলোক আমাকে নিয়ে ভিতরে গেলেন। তারপর চৌধুরী সাহেব হেঁকে বললেন, 'কই তোমরা সব গেলে কোথায়? দেখে যাও কে এসেছে।'
কিছুক্ষণ পরেই একজন ভদ্রমহিলা সেখানে এলেন। চৌধুরী সাহেব বললেন, 'আরে দেখেছ, আমাদের জামাইয়ের ভাগনে।'
: বলো কী?
তারপর ভদ্রমহিলা আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'তা ভাই তোমার আসতে তো কষ্ট হয়নি?'
: জ্বি না।
আমি একেবারে বিনয়ে বিগলিত।
ভদ্রমহিলা বললেন, 'ওমা, তোমরা ওকে এখনও কিছু খেতে দাওনি? এসো, এসো!' বলে তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে চললেন। তারপর যা ভূরিভোজন হলো। বিয়ের খাওয়াকে যা হার মানায়।
যাক, সে রাত্রি ভালোভাবেই কাটল। পরদিন সকালে নয়টার দিকে দুটি ছেলে এল। এ বাড়িরই ছেলে। একজনের নাম বুলু, অপরজনের নাম টুলু। তারা আমাকে এসে বলল, 'চলো আজ পদ্মবিলে শিকার করতে যাই।'
আমি আঁতকে উঠলাম। বলে কী! আমি যাব শিকার করতে! তাহলেই সেরেছে। শিকারে যাওয়ার ব্যাপারটাকে আমি তাই সরাসরি অস্বীকার করলাম। কিন্তু ছেলে দুটোও নাছোড়বান্দা। তারা আমাকে সঙ্গে নিয়ে যাবেই। আমি যতই অস্বীকার করি, তারাও ততই শিকারে নিয়ে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। আমি যুক্তি দিয়ে বুঝাই, 'শিকার জিনিসটা ভালো নয়, খামাখা কয়েকটি প্রাণীহত্যা।'
ওদের কাছে হার মানতেই হলো।
বিরাট পদ্মবিল, স্থানে স্থানে শাপলা রয়েছে। অবশ্য পদ্মফুলের নামগন্ধও দেখলাম না কোনোখানে। সেখানে ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে আসছে। শিকার করার জায়গাই বটে!
বুলু-টুলুরাই শিকার করছে। কিন্তু ওরা যে হঠাৎ আমাকেই পাকড়াও করে বসবে তা কে জানত। ওরা চার-পাঁচটা বক মারার পর আমার হাতে বন্দুক দিয়ে বলল, 'তুমি একটা শুট করো!'
আমি কী করে বলি যে, বন্দুক ছুড়তে জানি না। কিন্তু ওরাও আমাকে ছাড়বে না। বলে, 'শিকারে এসে যদি একটাও শুট না করো তবে এলে কী জন্যে?'
বাধ্য হয়েই আমাকে বন্দুক হাতে নিতে হলো। হাত কাঁপতে লাগল। ট্রিগারে টিপ দিলাম। আমার সামনেই বাঁ পাশে কিছু দূরে মোটরকারটা দাঁড় করানো ছিল। আমার গুলি ছোড়ার সঙ্গে সঙ্গেই মোটরের পিছনের চাকাটা সশব্দে ফেটে গেল। বুল-টুলু দৌড়ে গেল গাড়ির কাছে। তারপর গাড়ির পিছন থেকে বাড়তি চাকাটা এনে অনেক কসরত করে লাগাল। অবশেষে বাড়ি ফিরলাম।
আজ বিয়ের দিন। তাই বাড়ি সরগরম। কোনোমতে দিনটা কেটে সন্ধ্যা হলো। বর আসার অপেক্ষায় আমরা সবাই বসে রয়েছি। এমন সময় রব উঠল, 'বর এসেছে, বর এসেছে।' কিছুক্ষণের মধ্যেই বরযাত্রীসহ বর এলেন। আমি আনন্দিত হয়ে মামার কাছে গেলাম। কিন্তু কোথায় মামা! বর তো আমার মেজোমামা নয়। এদিকে চৌধুরী সাহেব এসে বরকে বললেন, 'এই যে বাবাজি, তোমার ভাগনে কালই এখানে এসে গিয়েছে।' বর আশ্চর্য হয়ে বললেন, 'ও তো আমার ভাগনে নয়। আর একে তো আমি চিনিই না।'
: এ্যাঁ, বলো কী?
চৌধুরী সাহেব হতভম্ব। আশেপাশে যে ছেলেরা ছিল তারা খেপে উঠল।
চৌধুরী সাহেব তাদের থামালেন। তারপর আমার দিকে চেয়ে বললেন, 'তুমি কি তাহলে মিথ্যে বলেছ?'
আমি বললাম, 'জ্বি না, আমি তো ব্যাপার কিছুই বুঝছি না। আমার মামা তো এখানেই আসতে বলে দিয়েছিলেন।'
চৌধুরী সাহেব বললেন, 'ঠিক আছে তুমি আজ এখানে থাকো। তোমার মামার বাড়িতেই টেলিগ্রাম পাঠাচ্ছি। সেখান থেকে কোনো লোক এসে তোমাকে নিয়ে যাবে। তোমার মামার বাড়ির ঠিকানা কী?'
আমি ঠিকানা বললাম। তিনি টেলিগ্রাম করতে লোক পাঠালেন।
রাতটা নির্বিঘ্নেই কাটল। পরদিন ছোটোমামা এসে হাজির। তিনি টেলিগ্রাম পেয়ে ছুটে এসেছেন। এদিকে চৌধুরী সাহেব এবং ওই ভদ্রলোকও এসেছেন। ছোটোমামার সঙ্গে তাঁরা অনেকক্ষণ আলাপ করার পরই ব্যাপারটা খোলাসা হয়ে গেল।
আসলে ব্যাপারটা হয়েছে এরকম:
ছোটোমামা আমাকে হিসাব করে বলেছিলেন বারোটি স্টেশন পরে নামতে। তিনি আমাকে চিটাগাং লাইনের গাড়িতে চড়েই বারোটা স্টেশন পরে নামতে বলেছিলেন; কিন্তু আমি ভুলে ময়মনসিংহ লাইনে এসে পড়েছি। কারণ ছোটোমামা আমাকে সাড়ে বারোটার ট্রেনে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু বারোটার সময় ময়মনসিংহ লাইনের একটা গাড়ি ছিল। আমি যখন স্টেশনে আসি, তখন ওই ময়মনসিংহের গাড়িটাই ছাড়ছিল। আর ভুল করে আমি তাতেই উঠে পড়েছিলাম। তারপর ময়মনসিংহ লাইনেই বারোটা স্টেশন পরে নেমে পড়লাম। ভাগ্যক্রমে সেখানেও চৌধুরী সাহেব নামে একজন লোক ছিলেন এবং তাঁরও মেয়ের বিয়ে আমার মেজোমামার বিয়ের পরদিনই ঠিক হয়েছিল। তাই ভুল করে আমি এটাকেই আমার মেজোমামার শ্বশুরবাড়ি মনে করেছিলাম!
ব্যাপারটা খোলাসা হতেই সবাই আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম। ছোটোমামা চৌধুরী সাহেবকে বললেন, 'এ যে দেখি রীতিমতো একটা অ্যাডভেঞ্চার। বারোটার ট্রেনটাই যত গন্ডগোলের মূল'- বলেই আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন।
# বহুনির্বাচনী প্রশ্ন
দীপুর পরীক্ষা শেষ। সে এবার প্রথম একা একা মামাবাড়ি বেড়াতে যাবে। তার জন্য ট্রেনের টিকিট কেটে দিয়েছে তার বাবা। যাত্রার দিন সে খুব ভোরে উঠে নিজের জিনিস গোছাতে থাকে। সে মনে মনে খুব আনন্দ অনুভব করে।
খান মোহাম্মদ ফারাবী ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। সৃষ্টিশীল মেধাবী এই লেখক ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থাতেই অনেক শিশুতোষ গল্প লেখেন। 'মামার বিয়ের বরযাত্রী' তাঁর অষ্টম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন রচনা। তাঁর রচিত কাব্য 'কবিতা ও অন্যান্য', প্রবন্ধের বই 'এক ও অনেক'; গল্পগ্রন্থ 'মামার বিয়ের বরযাত্রী' এবং নাটক 'আকাশের ওপারে আকাশ'। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে খান মোহাম্মদ ফারাবীর অকালমৃত্যু হয়।
স্কুলের বার্ষিক পরীক্ষা থাকায় মেজোমামার বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবারের সঙ্গে যেতে পারেনি গল্পের কিশোর ছেলেটি। তবে ছোটোমামার পরামর্শে সে পরীক্ষা শেষ করেই সরাসরি বিয়ের আসরে উপস্থিত হওয়ার পরিকল্পনা করে। দুপুর সাড়ে বারোটায় ছেড়ে-যাওয়া ট্রেনে করে বারোটা স্টেশন পরে নামলেই খুঁজে পাওয়া যাবে মামার হবু শ্বশুর চৌধুরী সাহেবের বাড়ি। স্টেশনে তাড়াহুড়ায় সে উঠে পড়ে ভুল ট্রেনে। সেখানে এক যাত্রীর সহযোগিতায় কাকতালীয়ভাবে আরেক চৌধুরীদের বিয়েবাড়িতে উপস্থিত হয়। বিয়ে বাড়িতে বরের ভাগনে হিসেবে কিশোরটি খুব সমাদর লাভ করে। কিন্তু বিয়ের অনুষ্ঠানে বর তাকে চিনতে না পারলে সৃষ্টি হয় বিব্রতকর পরিস্থিতির।
ঝোঁকের বশে কোনো কাজ করে ফেললে দুর্গতি পোহাতে হয়। এ গল্পে হাস্যরসের মাধ্যমে তা-ই দেখানো হয়েছে।
বরযাত্রী - বিয়েতে বরের সঙ্গী।
মিস - সুযোগ না-পাওয়া অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। ইংরেজি miss.
থ্রি চিয়ার্স - আনন্দ প্রকাশক শব্দ। ইংরেজি three chears.
মার্ভেলাস আইডিয়া - অপূর্ব চিন্তা। ইংরেজি marvelous idea.
বাতলে - উপায় বলা।
মিউনিখ - জার্মানির একটি শহরের নাম।
টাইম - সময়। ইংরেজি time.
থুরি- 'ভুল হয়েছে' বোঝানোর জন্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়।
চাপতে - চড়তে।
উৎফুল্ল - হাসিখুশি।
চেকার - টিকিট পরীক্ষক। ইংরেজি checker.
বিগলিত - গলে গেছে এমন।
পদ্মবিল - বৃহৎ জলাশয় বিশেষ। যেখানে প্রচুর পদ্মফুল ফোটে।
ভূরিভোজন - পেট পুরে খাওয়া।
নাছোড়বান্দা - যে লোক সহজে ছেড়ে দেয় না বা ক্ষান্ত হয় না।
পীড়াপীড়ি - অনুরোধ।
খামাখা - শুধু শুধু।
পাকড়াও - ধরো, গ্রেফতার করো।
শুট - গুলি করা। ইংরেজি shoot.
ট্রিগার - বন্দুকের গুলি ছোড়ার বিশেষ অংশ। ইংরেজি trigger.
কসরত - চেষ্টা।
সরগরম - জমজমাট, পরিপূর্ণ।
হতভম্ব - আশ্চর্য।
টেলিগ্রাম - তারবার্তা। ইংরেজি telegram.
নির্বিঘ্ন - বাধাহীন।
অ্যাডভেঞ্চার - রোমাঞ্চকর। ইংরেজি adventure.